জীবণ যেন এক বহতা নদী

ভালোবাসার গল্প (ফেব্রুয়ারী ২০২০)

শাহনাজ বেগম
  • ৩৭
এক
মিজান ও সাথি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী । তারা ইদানিং একে অপরের উপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে যে কাউকে ছাড়া কারো দিনই চলে না । প্র্যাকটিকাল থেকে শুরু করে ধরতে গেলে সব বিষয়ে । এতে তাদের যথেষ্ট সুবিধা রয়েছে । এক দিকে যেমন এক রিকসায় যাতায়াতে রিকসা খরচ কম হয় অপর পক্ষে প্রাইভেট পড়ার ঝামেলা ও নাই ।মিজান সাথির বাড়ির পাশেই এক মেসে থাকে । একে অপরের সহযোগিতায় ওরা জটিল সমস্যা গুলোও সমাধান করে ।
মিজান গ্রামের মাঝারি ধরনের কৃষকের ছেলে । কয়েকটি মেয়ের পরে একমাত্র ছেলে । মা বাবা অঢেল টাকা পয়সা দিতে পারে না । অপরপক্ষে সাথি শহরের মেয়ে । বাড়িটা যদিওবা দুতলা ওর বাবা সাধারণ একজন ব্যাবসায়ী। মাঝে মাঝে টাকা পয়সার যে একেবারেই সমস্যা হয়না তা নয় । তাই ওরা একে অপরের সহযোগিতায় লেখা পড়া চালিয়ে যায় । এর ফলাফল মোটামুটি ভাল ।
এক সময় সাথি বলল – দু এক দিনের মধ্যে আমাকে দেখতে আসবে । পছন্দ হলে বিয়ে । তোর সাথে থাকার দিন গুলি শেষ ।
মিজান বলল – তাই , লেখাপড়া শেষ না হতেই বিয়ে করবি ?
সাথি – কি করব , বাড়িতে তাই সিদ্ধান্ত চলছে ।
মিজান – দাওয়াত দিতে ভুলিস না । কি উপহার দেব তোকে ?

সাথি একটু চিন্তা করে বলল - পরে বলব । আগে শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে দেখব কি প্রয়োজন তারপর বলব । এসব কথা বলে তারা প্রতিদিনের মত যার যার বাসায় চলে গেল ।

রাতে মিজানের পড়ার টেবিলে সাথির বিভিন্ন স্মৃতি গুলোর উপর নজর পড়ে । সাথির সুন্দর করে লেখা নোটগুলো যেন খিচ খিচ করে মিজানের মনে আঘাত হানতে লগল । সাথির বিয়ে হয়ে গেলে কোথায় পাবে এগুলো । সাথিই বেশির ভাগ দিনের রিক্সা ভাড়া দেয় । মাঝে মাঝে দু একশত টাকা পকেটে যে আসে না - তাও নয় । পরে দেব দেব করে আর দেওয়াই হয় না । সাথি কোন দিনই টাকার ব্যাপারে মুখ খোলে না । এ ছাড়াও সাথি যুগ হিসাবে যথেষ্ট ভাল । তার কোন বয় ফ্রেন্ড নাই ।
এসব ভাবতে ভাবতে রাত গভির হয়ে যায় । দুচোখে ঘুম নেই। মনের শান্তিটা যেন আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে । অন্তরের অন্তস্থলে কে যেন বলছে তুমি কেন সাথি কে জীবণ সাথি করে নিতে পারো না । সাথি কিসে কমতি ? রুপে না গুনে ? রুপ তার ঠিকরে পড়া নয় বটে, তার মত গুনবতি কয়জন আছে ?তুমি শুধু রুপটায় দেখলে, গুণ টা নয় ? কোথা থেকে অচেনা অজানা মেয়ে নিয়ে আসবে সারা দিন খ্যাচ খ্যাচ করবে , বিভিন্নভাবে জ্বালাতন করবে ।
মিজান ঘুমানোর চেষ্টা করছে ঘুম আসছে না । সে ভাবে - এসব সে সাথিকে বলবে । কিন্তু কেমন করে বলবে ? কি ভাববে সাথি । সে একবার মোবাইল টা হাতে তুলে নেয় আরেকবার রাখে । এক সময় সে সাথিকে কল করল ।
সাথি – কিরে , এত রাতে যে ফোন দিলি , কি বলবি বল ,।
মিজান – এমনি দিলাম ।
সাথি – এমনি দিলি ? বল কি বলবি ?
মিজান – না থাক , দেখা হলে বলব ।

পরদিন যথারিতি যখন দেখা হল সুযোগ বুঝে মিজান বলল আমরা এভাবে এক সাথে সারা জীবন কাটাতে পারি না ?
সাথি – পারি কিন্তু তা উভয় পক্ষের অভিভাবকদের সমর্থনে হলে হবে । আমি আমার বিয়ের ব্যাপারে একা একা কোন সিদ্ধান্ত নেব না ।
মিজান – কেন ? তুই কি আদি যুগের মেয়ে হলি নাকি ?
সাথি- কিছুটা তাই ।

মিজান তার হাত ধরে ফেলে অনুরোধের সুরে বলে – কেন নয় বল তো ? আমি কি তোর যোগ্য নই । আমার অনুরোধটা শোন ।
সাথি বলল – কেন নয় শুনবি , এর পিছে রয়েছে বিরাট একটা গল্প । শোন -
আমার বড় বোনের নাম ছিল জুলেখা । নাম শুনে তো বুঝতেই পারছিস সে সুন্দরি ছিল । ও ছিল আমার মায়ের মত আর আমি হয়েছি বাবার মত ।
মিজান মন দিয়ে গল্প শুনছে , বলল- তারপর ।
সাথির কন্ঠস্বর এঁটে এসেছে । কাঁদ কাঁদ স্বরে সে বলতে থাকল - অল্প বসেই আপু এক ছেলের প্রেমে পড়েছিল । পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল । বাবা আমার মেনে নিয়েছিল কিন্তু ছেলের পরিবার মেনে নেয় নি । অনেক দিন পর যখন ওরা আপুকে নিয়ে গেল সারাক্ষণ জ্বালাতন করত । এক সময় দুলাভাইও ওদের পক্ষ নিয়ে মারধর করত । সাথির কান্না বেড়ে গেল । সে কোন রকমে বলল আপু আমার বিষ খেয়ে জীবন দিয়েছে ।
মিজান বলল – আসলে জীবন টা একটা বহতা নদির মত । এটা কোন কারনে বাধাগ্রস্থ হলেই সমস্যা ।
সাথি এতটা নার্ভাস হয়ে গেল যে , মিজান তাকে একা বাসায় পাঠাতে পারল না । সে একটা রিকসা ডেকে সাথির বাড়ির পথে রওয়ানা দিল ।
সাথির মা মরিওম অধির আগ্রহে ব্যালকনিতে বসে মেয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল । সে দেখল সাথি রিকসা থেকে নামল আর একটি ছেলে রিকসায় ফিরে গেল ।
মরিওম বলল – এতক্ষন কোথায় ছিলি আর ঐ ছেলেটা কে ? তুইও কি প্রেম করা শুরু করেছিস নাকি ? তোর কোন কিছু শুনতে পেলে আমিই আগে জীবন দেব ।
সাথি – চুপ কর তো মা ।তুমি সব সময় শুধু ওই কথাটাই বল । আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম তাই ও আমাকে রাখতে এসেছিল ।
মরিওম মেয়ের মুখের দিকে দেখে কিছুটা তাই আন্দাজ করল । তখনকার মত আর কিছু বলল না ।
দুই
সাথি ও মিজানের এখন লেখাপড়া প্রায় শেষের পথে । সাথির বিয়ে এখনও হয়নি । ওদের দুজনের মধ্যে যে ভালোবাসার বিজ অংকুরোদ্গম হয়নি তা নয় , তবে দুজনের সম্পর্ক টা মানুষের চোখে পড়ার মত নয় । ওরা কখনে পার্কে বা অন্য কোথাও যায় না । লুকিয়ে মেলামেশার চেষ্টাও করে না । দুজনে দুজনের সাহায্য সহযোগিতায় দিন কাটছে তাতেই ওরা সন্তষ্ট । তবে মন তো আর কারো বাধা মানে না। তা বহতা নদীর মত ও বয়ে চলে ।তারা শয়নে স্বপনে ভালোবাসার স্বপ্ন আঁকে । এখন আরো সহযোগিতা বেড়ে গেছে, চকুরির জন্য পড়া, বিভিন্ন দরখাস্ত করা ইত্যাদি ।
আজকাল সাথির বাবা প্রায় বাড়িতে আসে না । বলে, ব্যবসার কাজে বাইরে থাকতে হয়েছে । এখন দিন কাল বদলে গেছে মাল ক্রয় বিক্রয় অত সহজে হয় না ।
মরিওম প্রশ্ন করলে বলে - তোরা কি বুঝবি, তোরা তো বাড়িতে বসে বসে খাস । আর আমাকে কত কষ্ট করতে হয় । তোর তো একটা ছেলেও হল না ।
মরিওম দেখে ব্যাবসার উন্নতিটা কোথায় ? সে তো নিচতলার দুটি দোকান ও একটি পরিবারের ভাড়ায় কোন রকমে দিন কাটছে।
বাবা না থাকায় বিভিন্ন কাজ়ে সাথি মিজানকে ডাকে । যেমন ধর মায়ের ডাক্তারের কাছে যাওয়া ছোট বোন সিমথিয়াকে স্কুলে ভর্তি করতে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি ।
মরিওম লক্ষ্য করে যে , ছেলে টা মন্দ নয়, যেমন দেখতে বেশ তেমন মনটাও ভাল । মনে মনে ভাবে উহঃ আল্লাহ , এমন একটা ছেলে যদি তার হত , তাহলে স্বামির কটাক্ষ কথাগুলো তাকে শুনতে হত না । এমন ছেলের হাতে মেয়েকে দিতে পারলেও মন্দ হয় না । কিন্তু চাকুরি বাকুরি না পেলে তা কি করে সম্ভব ।শুনেছি ওর বাড়ির আর্থিক অবস্থাও তেমন ভাল নয় ।
বিভিন্ন বিষয় ভাবতে ভাবতে মরিওমের সুন্দর চেহেরায় মলিন ছাপ পড়েছে । কখনও ভেসে ওঠে মরা মেয়ের স্মৃতি কখনওবা সাথির ভবিষ্যৎ । সিম্থিয়ার লেখাপড়ার খরচ তো আছেই । যে স্বামি তাকে ছেড়ে একটি দিনও কাটায় নি আর আজ কিনা প্রায়ই বাড়ি আসে না । স্বামি সম্পর্কে তার অনেক ধারনাই জাগে কিন্তু তা বলা যায় না । না জানি সেও যদি বড় মেয়ের মত সুইসাইট করে ফেলে ।
ভাবতে ভাবতে সে এক সময় মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে মিজানের সাথে সাথির বিয়ের প্রস্তাব টা সে দিবেই ।
একবার মেয়ের পাশে গিয়ে বলল – হ্যারে সাথি , মিজান কি তোকে কিছু বলে ?
সাথি – কি বলবে ?
মা – তোকে কি ও পছন্দ করে না ?
সাথি – অনেকদিন আগে একদিন বলেছিল, আমি না করেছি ।
মা – একদিন চল না ওদের বাড়িঘর দেখে আসি । পছন্দ হয় তো কারো দ্বারা প্রস্তাব দেব । তোর বাপের যে কি হল তার তো কোন চিন্তায় দেখছিনা । কয়েক দিন পর পর আসছে আর বলছে ব্যাবসার কাজে ব্যাস্ত আছি । ব্যাবসাতে তো কোন উন্নতিই দখছি না ।
সাথি – যাওয়া যায় , কোন দিন যেতে চাচ্ছ ? তাহলে মিজান কে বলি ।
মা – থাম , তোর আব্বা আসুক , বলে দেখি , কি বলে ?
তিন
সাথি , সিম্থিয়া ও মরিওম - তিন মা মেয়ে এসেছে মিজানের বাড়িতে । গ্রামের মধ্যবৃত্ত ধরনের বাড়ি । এক দিকে মাটি দিয়ে তৈরি টিনের দুটি চৌচালা ঘর, অন্য দিকে রান্নাঘর ও গোয়াল ঘর ।বারান্দা ও উঠান গোবর মাটি দিয়ে পরিপাটি করে লেপা । বিছানায় পাতা আছে নকসি কাঁথা । মাটির ঘরে থেকে থেকে মানুষ গুলির মনও যেন মাটির মত নরম । এক নিমিষেই তারা মেহমানদের সাথে মিশে গেল । মনে হয় কত কালের চেনা ।
বারান্দায় ওরা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছে । মিজানের ছোট দুই বোন সেলি ও বেলি এসে সালাম দিল । ওদের মা বলল - এগুলো আমার মেয়ে সেলি ও বেলি । পোত্তেকদিন বিয়ের ঘর আসে , আমি বলি আমার মিজান চাকুরি পাক তখন যৌতুক টৌতুক যা লাগে তা দিয়েই বড় ঘরে বিয়ে দেব । বড় দু মেয়ের বিয়ে দিয়েছি বুবু , দু বিঘা জমি বন্দক রাখছি । আমার মিজান চাকুরি পাইলে ছুটাব ।
মরিওম বলল – হ্যাঁ, আল্লাহ দিন চাকুরি হোক ।
একটু পর মরিওম বাথ্রুম যেতে চাইলে পানির বদনা হাতে দিয়ে বাড়ির পিছনে মাটির দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছোট্ট ঘর টি দেখিয়ে দিতে দিতে মিজানের মা বলল- মিজান চাকুরি পেলে বুবু এগুলো সব ভেঙ্গে ইট দেব ।
মরিওম ওই একই কথা বলল- করিয়েন , আল্লাহ দিন চাকুরি হোক ।
বাথ্রুম সেরে এসে মরিওম বদনা হাতেই গোয়াল ঘরে বাধা গরু গুলোর দিকে দেখছিল । সুন্দর চেহারা গরুগুলোর । অনেক দাম হবে । মিজানের মা এগিয়ে এসে বলল- এগুলো পুষছি বুবু , মিজানের চাকরির সময় দরকার হলে বিক্রি করব ।
এক কথা বারবার শুনতে একটু বেমানান লাগলেও মরিওম কিছু বলল না । সে বুঝতে পারল মায়ের মনের আশা। এরা নরম মনের মানুষ , এরা ভাল বা মন্দ কোন আবেগেই মনের মাঝে চেপে রাখতে পারে না ।
রাতের বেলা খেতে বসলে মরিওমের পাতে দিল প্রকান্ড এক মাছের মাথা । মরিওম আপত্তি জানালে বলল – না না আপনিই খান এগুলো আমাদের বাড়ির পুকুরের মাছ ।
খাওয়া দাওয়ার পর মিজানের মা স্বামির হাতে পান দিচ্ছে । দু জনের মুখে চোখে হাসির ঝিলিক । মেহমান আসায় যেন হাসির চিকমিকিটা আরেক টু বেড়েছে । মরিওম দূর থেকে দেখে সেই হাসি ,মনে মনে ভাবে কতদিন থেকে তার স্বামির সাথে এভাবে হাসি হয়নি । যে মানুষ কত হাসত কেন যে আর হাসে না । বাড়িতে আসলে কেন যেন অপরাধির মত জড়সড় হয়ে থাকে একটুও হাসে না । কোন কোন দিন সারারাত অনিদ্রায় কেটে দেয় ।
মরিওমের মানুষগুলোকে কেন যেন খুবই ভালো লাগছে , মনে হচ্ছে কত কালের চেনা । ইচ্ছা করছে মেয়ের বিয়ের কথাটা বলি । কিন্তু তা তো আর বলার কথা নয় । মা হয়ে কি কেউ কোন দিন সরাসরি মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব দেয় ? তা ছাড়াও তো চাকুরি ছাড়া মিজানের বৌইয়ের ভোরন পোষন চালানো সম্ভব নয় ।
সাথির বড় লজ্জা করছে । একজন উচ্চ শিক্ষিত মেয়ে হওয়া সত্বেও সে লজ্জায় মুসড়ে যাচ্ছে । সে ঘর থেকে বেশি বের হলো না । দু একবার মিজানের ঘরে গিয়েছিল । ঘরটা অতটা পরিচ্ছন্ন নয় । ইচ্ছা করছিল গুছিয়ে দেবে কিন্তু মানুষে কি বলবে ? সে মনে মনে ভাবল কয়েকটি ওয়াল মেট তৈরি করে পাঠিয়ে দেবে সে সুন্দর করে ওয়াল মেট বানাতে পারে । সে মিজান , সেলি ও বেলির সাথে গ্রামে ঘুরতে গেল ।যদিও বা মিজান ততটা ফ্রি নয় । মিজানের মনে পাছে লোকে কিছু বলে এমন একটি ভাব । গ্রামটি ওকে খুব ভাল লাগল ।
পরদিন বিকেলে ওরা বাসায় ফিরে এল ।

চার
মিজান ও সাথির সম্পর্কটা এখন প্রায় সকলেই জানে । ওরা এখন এক সাথে অনেক যায়গাতেই যায় । প্রাণ খুলে হাসে মজা করে । এসব সাথির বাবাও জানে । তবে এ বিষয়ে ওর বাবা ওকে কোন প্রকার চড়াও করেনি যেমন টি করে ছিল বড় মেয়েকে । বড় মেয়ে যখন প্রেমে পড়ে তখন ওর বয়স ছিল নিতান্তই কম । সাথি এখন প্রাপ্তবয়স্ক । ওর ভালমন্দ ও যথেষ্ট বোঝে। তা ছাড়া তার ও সব নিয়ে ভাব্বার সময়টায় বা কোথায় ? আজ কাল তাকে বেশ চিন্তিত ও ব্যস্ত দেখায় ।
মিজান যে সাথিকে ভালবাসে মিজানের পরিবার অনুমানে তা ধরে ফেলেছে ।ওরা তো মহাখুশি।
সেলি প্রায়ই ভাবে - ভাইয়া ও সাথি আপুর লেখাপড়া এখন শেষ । এখন ওরা চাকুরি পাবে । চাকুরি পেলেই ওদের বিয়ে । ভাইয়ার বিয়েতে সে সুন্দর জামা নিবে । তারপর তার নিজের বিয়ে । মা বলেছে যৌতুক টৌতুক যতই লাগুকনা কেন বড়লোকের ঘরে বিয়ে দিবে । তার মনে বিয়ের স্মৃতি ভেসে উঠে । গায়ে অনেক গয়না । মাইক্রতে চড়ে জামাই এসেছে ।
আর কিনা আজ ছোটলোক মনা কাকার ছেলে মিলন গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিল । সে আড়াল থেকে এসে বলল – আই লাভ উই সেলি । সেলি মারল এক চড় । বলল, আর যদি কোন দিন ও কথাটা বলিস , ভাইয়াকে বলে তোকে পুলিশের হাতে দিব ।
মিলন ভয় পেলেও মুখের জোরে বলল _ যা , যা , তোর মত মেয়ে আঠারো গোন্ডা আছে । কত পুলিশকে ধরাতে পারিস ধরা যা ।
ওদিকে বেলি ভাবে - ভাইয়া ও সাথি আপু প্রেম করে আমি করলে দোষ কি ? আমি ত আর এখনই বিয়ে করছি না । সাথি আপুর মত লেখা পড়া শেষ করব , চাকুরি করব, তার পর বিয়ে । সাথি আপু যখন ভাবি হয়ে আসবে তখন তার কাছে পড়া গুলো বুঝে নিবে । উহঃ কি মজাটায় না হবে । এখন না বুঝে পড়ে লাভ কি ?
তাই সে লেখাপড়া বাদ দিয়ে তার এক ক্লাস ফ্রেন্ড মিন্টুর সাথে নিয়মিত ফোনে কথা বলার চেষ্টা করে । কারো একটা মোবাইল ফোন পেলেই কখনো যায় বিলের ধারে কখনোও বা বনের আড়ে ।
কিছুদিন পর পরই পথঘাটে দেখা পেয়ে কেউ না কেউ মিজানের বাবাকে বলে – আসসালামু আলাইকুম ভাই , কেমন আছেন ছেলের বিয়ে লাগাবেন না ? খুব ভাল একটা ঘর আছে ।
মিজানের বাবা বলে – কি করব ভাই , আজ কাল যুগ হয়েছে অন্য মত । বউ ঠিক করায় আছে । ছেলের চাকুরিটা হলেই বিয়ে হবে । মেয়ে খুব ভাল অনেক লেখাপড়া জানা । আমার ছেলের সমানই ।বউও চাকুরি পাবে , বিয়াই সাহেবের দু তলা বাড়ি ।
ঘটক বলে – তাহলে তো ভালোই ।
মিজানের বাবা – জি আপনাদের দোয়ায় ভালয় ।অনেক আশা করে ছেলেকে পড়িয়েছি ভাই । দোয়া করেন চাকুরি বাকুরি একটা হোক ।
মিজানের মা তো আরো খুশি । প্রাণ খুলে সকলের সাথে হাসে । বার বার মিজানের ঘরে গিয়ে সাথির দিয়ে পাঠানো ওয়াল মেট গুলো দেখে আর ভাবে উহ কতই না সুন্দর কারুকাজ ! কবে আসবে ঘরের লক্ষ্মি !
পাঁচ
আজ সাথি সবগুলো নামাজ পড়েছে । যতবার নামাজ পড়েছে দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে প্রাণ ভরে দোয়া করেছে ।বলেছে- হে আল্লাহ জীবনের রুজিরোজগার দিন , আপু কে জান্নাতে দিন । পরিবারে শান্তি দিন , আরো অনেক কিছু চাওয়া পাওয়া সে বলেছে ।
সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের পরে সে মাথায় ওড়নাটা দিয়েই মোবাইল ফোনটা নিয়ে বসেছে । আজ একটা চাকুরির রেজাল্ট । উহ আল্লাহ ! কি যে ভাগ্যে রেখেছেন । প্রথমে সে নিজের রোল নং দিয়ে সার্চ দেয় । তা না পেলে নিজের হয়নি বুঝতে পেরে মিজানের রোল নং দিয়ে সার্চ দেয় । মনে মনে বলে – হে আল্লাহ ! আমারটা না হলেও যেন মিজানের টা হয় । নেট ওয়ার্ক ফেইল্ড দেখালে সে ভারাক্রান্ত মনে মোবাইল টা শিওরে রেখে কম্বলটা টেনে শুয়ে পড়ে ।
ওদিকে মা সারাদিন গুন গুন করে কাঁদতে কাঁদতে এখন জোরে কাঁদা শুরু করেছে । আজ আপুর পঞ্চম মৃত্যু দিবস । প্রতিবারই আপুর মৃত্যু দিবসে মৌলবি ডেকে দোয়াখায়ের করে খাওয়া দাওয়ার ব্যাবস্থা করা হয় । কিন্তু বাবা না থাকায় আজ করা সম্ভব হলো না । মিজানকে বললে হয়ত মৌলবি ডেকে দিত , খরচ করে দিত কিন্তু টাকার তো প্রোয়োজন । আজকাল বাবা তো কোন টাকায় দেয় না । বাবা থাকলে হয়ত মাকে নানা বুঝসুজ দিয়ে থামাত । দরকার হলে দু কথা ঝাড়ি মেরে বলেও থামাত ।
সাথির মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে ।বহতা নদীর মত জীবন খানি যেন আজ থেমে যেতে চায় ।যেন জীবন গড়ার স্বপ্নের ফুল গুলো অকালেই ঝরে যাচ্ছে । ইস ! সে আর ভাবতে পারছে না । এত দিনের হয়রানি আর বছর বছর পাশগুলি কি বৃথায় গেল ? বেচারা মিজানেরও যে কি হয় ? ও ছেলে মানুষ ! ওর প্রতি চেয়ে আছে ক্ষুধার্ত ভবিষ্যৎ । মাসগেলেই বাবার কাছ থেকে বাবার কষ্টের টাকা আনা , মেসের সংকির্ন বিছানা আর পাতলা ডাল খাওয়ার কষ্ট আল্লাহ বৃথা দিওনা । হে আল্লাহ আমার না হলেও যেন তার হয় ।এ সব ভাবতে ভাবতে রাত গভির হয়ে যায় ।
দুখিনি মাতা নামাজের পর কুরআন পড়ে মেয়ের পাশে এসে বসেছে । সাথির পাশে সিমথিয়া অঘোরে ঘুমাচ্ছে ।
মা বলল- হ্যারে তোর যে আজ রেজাল্ট হওয়ার কথা ছিল ? কি হল , তোর হয়নি না ?
সাথি মুখ ঢেকেই বলল- না ।
মা – মিজানেরও হয়নি ?
সাথি – জানি না ।
এমন সময় মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল । সাথি কল রিসিভ করলে মিজান বলল- কিরে মন খারাপ করেছিস ? তোর না হলেও আমার তো হয়েছে । যাক এক জনের তো হয়েছে । খাওয়া দাওয়া করেছিস ?
মা মেয়ে কিছুটা শান্ত হলো । চৈত্র বৈশাখ মাসে যেমন খরায় মাঠঘাট শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায় ঘাস তৃণলতা পুড়িয়ে যায় । হঠাৎ কাল বৈশাখির বৃষ্টিতে আবার তা প্রাণ ফিরে পায় ঠিক তেমনি মা মেয়ের মনটা সতেজ হয়ে ওঠে ।
মরিওম নিজের জীবন দিয়ে বুঝতে পেরেছে মেয়েদের স্বাবলম্বি হওয়া প্রয়োজন । তাই মেয়েকে নিয়ে খেতে বসে বলল- আবার কখন সার্কুলার ছাড়বে তুই আবার দরখাস্ত কর ।
সাথি বলল- তা তো করবই ।
মরিওম – এবার ভাল করে পড় , দরকার হলে আমার গহনা গুলো বিক্রি করে যোগাযোগ করব ।

ছয়

সাথির বাবা গফফার যে ব্যাবসা করে তার মাল আসে ভারত থেকে । একদিন সে খবর পায় যে পথে পুলিশ পাহারা রয়েছে । তাই যে বুড়ির বাড়িতে মালামাল রাখা হয় সে বাড়িতেই থেকে যায় ।
যদিওবা গফফার নিজ খরচে খায় তবুও বুড়ি ও বুড়ির মেয়ে মহসিনার আথিত্যে আপ্যায়নে কোন ত্রটি নেই । তারা সুন্দর করে রান্না করে এবং যত্ন সহকারে গফফারকে খেতে দেয় ।
মাছমাংস খেতে পেয়ে মহসিনা কেমন প্রাণ খুলে হাসে । সে পথের দিকে চেয়ে চেয়ে পুলিশ কোন দিকে গেল না গেল এসব তথ্য সংগ্রহ করে গফফারকে সাহায্য করে ।
গফফারের ভাল লাগে তার হাসি । মহসিনা যখন সুন্দর করে চুল বেধে পথের পানে চেয়ে থাকে আহা কী অপরুপ লাগে ! ভাল লাগে তার হরিণির মত চাহনি ।
এখন গফফার প্রায়ই মাঝে মাঝে এদের বাড়িতে থেকে যায় । বাড়িতে গে্লে কেমন যেন ভ্যাপসা ভাব , কারো সাথে কোন কথা নেই, হাসি নেই , যেন বিষন্নতায় ভরে আছে সারাটি বাড়ি।
বুড়ির এই একমাত্র মেয়ে ছাড়া দুনিয়াতে আর কেউ নেই । কেউ না থাকায় মেয়ের বিয়ের ঘরও কেউ দেখল না যথা সময়ে বিয়েও হলো না ।
এরই মধ্যে শুরু হলো গ্রামশুদ্ধ কানাঘুষা । কেউ বলে , গফফারের সাথে মহসিনার বিয়ে হয়েছে ,কেউ বলে হবে । কেউবা বলে নাহ! তা কি করে হতে পারে , বয়সে অনেক ফারাক ।
এসব শুনে ওরা একরকম জেদ ধরে বসে । বলে বিয়ের কথা মানুষ বলছে তো বিয়েই করব , দেখি কে কি করতে পারে । ঠিকই একদিন মুন্সি ডেকে বিয়ে পড়া হল ।
এবার গ্রাম বাসিরা বলল - দেখ , নয় বেলে । কেউ বলল - আমার আইডিয়াই ঠিক ,কেউ বলল- ভালো হয়েছে । কেউ বা বলল- ছি ছি ছি এ কেমন কথা ।
মরিওম এতদিন মনে মনে যা ভাবত তা ঠিকই হল।
বিয়ে করা বছর হয়ে গেল কিন্তু আজও তা মুখ খুলে কাউকে বলতে পারেনি । কতবার চেষ্টা করেছে মরিওমকে বলবে কিন্তু না তা বলা যায় না । দুখিনি মরিওম মেয়ে মরার শোকে মুসড়ে আছে এমতবস্থায় এসব বলা যায় না । ইচ্ছা করে ছোট স্ত্রিকে তালাক দিবে কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তার বাচ্চা হবে । ডাক্তার বলেছে ছেলে হবে । গফফার মনে মনে খুব খুশি । যা হোক ছেলে তো হবে । বিয়ে না করলে কোথায় পেত সে ছেলে ।
আজকাল মহসিনার চলাফেরায় খুব ধাই হয়েছে । ডাক্তার বলেছে আরো দশদিন পর সিজার করতে হবে । আহা এত কষ্ট ! কে থাকবে মহসিনার কাছে । বয়স্ক মা কি আর করতে পারে ? এসব ভাবতে ভাবতে গাফফার সিদ্ধান্ত নেয় সিম্থিয়াকে আনিনা কেন ? কিছু না করতে পারলেও তো সাথে থাকবে , রাত টাতে কখন কি হয় না হয় । আমি তো আর বসে থাকলে চলে না ।ব্যাবসা না করলে সিজারের টাকা পাব কোথায় ?
পরদিন বাড়িতে এসে সিম্থিয়াকে বলল – আমার সাথে বেড়াতে যাবি সিম্থিয়া ।
এমন মধুর সুর পরিবারের লোকজন অনেক দিন থেকেই শোনে নি । তাই সিমথিয়াও যেন মধুর সুরে বলল কোথায় আব্বু ?
গাফফার বলল- আমি যেখান থেকে মাল আনি ।
সিম্থিয়া বলল- তুমি নিয়ে গেলে যাব ।

সিম্থিয়া এসেছে নতুন এক জায়গায় । এরকম বাড়িতে সে কখনও আসেনি । চারদিকে কোন প্রাচির নেই । দুটি মাত্র প্লাস্টার বিহিন নতুন ইটের ঘর । বাথ্রুম ব্যাবস্থাও ঘরের বাইরে । সিম্থিয়ার ইচ্ছা হচ্ছিল এখনি পালিয়ে যাই । কিন্তু তা কি আর হয় ! একটু পরেই রাত নেমে এল । বুড়ি ও বূড়ির মেয়ের মধুমাখা আচরনে সিম্থিয়ার কয়েকদিন কেটেই গেল ।
ওর আব্বা ওকে নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের সিমান্তে যায় । ভারত ও বাংলাদেশ সম্পর্কে মেয়েকে ধারনা দেয় । বাবা বলে একদল লোক মাল এনে ওই বাড়িটায় রাখে তার পর ওখান থেকে নিয়ে গিয়ে আমি বিক্রি করি ।
কয়েকদিনে সিমথিয়ার বেশ কয়েকটি বন্ধু জমেছে । ওদের সাথে সে উঠানে এক্কা দোক্কা খেলছে । নিকটেই বুড়ি একটি কাটা গাছের গুড়িতে বসে আছে । একজন মহিলা সিমথিয়াকে লক্ষ করে বলল - কে এটা ? মহসিনার মেয়ে নাকি ?
বুড়ি বলল – হ্যাঁ ।
সিমথিয়া বলল – নাহ । আমার মায়ের নাম তো মরিওম । আমি মরিওমের মেয়ে ।
মহিলা বলল - এটাও যে তোমার মা , তোমার বাবা যে একে বিয়ে করেছে । বাপ যতটা বিয়ে করবে তত টায় মা ।
বুড়ি চোখের ইশারা দিয়ে মহিলাটিকে থামাল । মহিলা বলল , ওরা জানে না হ্যা ।
বুড়ি বলল - নাহ ।

এবার সিমথিয়া বুঝেছে, তাইতো বাবা কাল মহিলাটির সাথে চোখে চোখ রেখে কেমন যেন বে সরমের মত হাসছিল ।সে এখন বুঝেছে এ জন্যই ঘরের আলনায় অই মহিলার কাপড় চোপড় আর আব্বুর কাপড় এক জায়গায় ।

সিমথিয়ার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল ।সে সৎ মায়ের কাহিনি অনেক পড়েছে । আফান দুলালের কাহিনি পড়েছে , সুয়োরানি দুয়োরানির গল্প পড়েছে । সে ভাবে - ইস রে সৎ মা , আফান আর দুলাল কে জল্লাদের হাতে দিল । না বাবা না , এখানে থাকা যাবে না , সে এখনই বাড়ি যাবে । মাকে তার বলতেই হবে যে - বাবা বিয়ে করেছে । মা এতে অবশ্যই দুঃখ পাবে । হয়ত মা কাঁদবে , আপুও কাঁদবে ।
এবার তার নিজের চোখেই পানি এলো । সে ঘরে ঢুকে নিজের জামাকাপড় গুলো নিয়ে কাউকে কিছু না বলে যে পথ দিয়ে এসেছিল সে পথে রওয়ানা দিল ।
যখন গ্রামটা পেরিয়ে বিশাল একটা মাঠের পৌছিল তার মন চমকে উঠল । সে পথের ধারে বসে কান্না শুরু করে দিল । দু চার জন পথচারি তাকে ঘিরে ধরেছে । তাকে নানা প্রশ্ন করছে সে কিছুই বলছে না ।
ইতি মধ্যেই তাকে খোজ খোজ রব পড়ে গেছে । বাবা এসে বলল –ওখানে চল , কাল তোমাকে বাড়ি নিয়ে যাব । সে যখন যেতে রাজি হলো না বাধ্য হয়ে বাবা তাকে বাড়িতে নিয়ে এল ।
বাড়ি এসে মাকে জড়িয়ে ধরে সিমথিয়ার সে কি কান্না । মা কান্নার কারন জানতে চাইলে সে তখনকারমত কিছুই বলতে পারল না ।
পরে কান্না থামলে যা দেখেছিল যা শুনেছিল সবই মা ও অপুকে বলল । এতে সাজানো একটি সংসারে দুঃখের ছায়া নেমে এল অপর পক্ষে গাফফারের আস্ফালন দ্বিগুন হারে বাড়ল ।সে বলে এটা আমার বাড়ি আমি যা ইচ্ছা করতে পারি । দরকার হলে তোমাদের বের করে দিয়ে মহসিনা আনব , দেখি কে কি করতে পার ।
মরিওম ভাবল চুপ থাকায় শ্রেয় । সে নিজে চুপল ও মেয়েদেরকেও কিছু না বলতে বলল।



ছয়
মহসিনার ছেলে হয়েছে । সাথি ও সিম্থিয়ার নামের সাথে মিল রেখে ওর নাম রাখা হবে সিফাত ।নাম ঠিক করেছে বাবুটার নানি । তেখতে ঠিক বাবার মত ।

গফফারের এই বিয়ের কথা বন্যার পানির মতই বেড়ে চলেছে ।তা সব আত্মিয়ের কানে পৌছে গেছে ।এদের যে কোন কাউকে কেউ দেখা পেলে কৌতুহল বসত নানা প্রশ্ন করে ।
যেমন, সিম্থিয়াকে দেখা পেলে বলে তোমার মায়েরা ঝগড়া করে ? কোন মা বেশি ভাল ?
গাফফারকে দেখা পেলে বলে কোন গিন্নি বেশি ভাল । মরিওমকে পেলে বলে স্বামি কাকে বেশি ভালোবাসে ? কোথায় বেশি থাকে ?

এক সময় এ কথা মিজানের পরিবারেও পৌছে যায় । মিজানের মা বলে _ না বাবা না , ও ঘরের মেয়ে নেওয়া যাবে না , বাপ বিয়ে করেছে , ছেলে হয়েছে , জমিজমা নাই, একটা মাত্র বাড়ি , ওটা তো এখন ছেলেই পাবে । মেয়েরও চাকুরি হল না ।আমার ছেলে চাকুরি পেয়েছে , চাকুরি করা বউ নেব ।

মায়ের এসব কথা মিজানের মনেও যেন দাগ কাটে । আজ কাল সে আগের মত আর সাথির সাথে অত ফ্রি ভাবে কথা বলে না । তাছাড়া সময়ই বা কোথায় ? চাকুরি নিয়ে সব সময় ব্যাস্ত থাকতে হয় । এখন সে তো আর ছেলে মানুষ নয় ! এখন সে পুরুষ । ওসব প্রেম প্রেম গল্প যেন তার আর ভাল লাগে না ।

ওরা মহসিনার ছেলের নামকরনের অনুষ্ঠানে সবাই এসেছে ।সাথির ইচ্ছা করছিল মিজানকেও ডাকে ।কিন্তু মিজান তো আজকাল ভালোভাবে কথায় বলে না । তাছাড়া নতুন চাকুরি ছুটি পাবে কিনা । আর সেই বা কি ভাববে - বুড়ো বয়সে বাবা বিয়ে করেছে , এ কেমন পরিবার রে বাবা ।

ওরা মিষ্টি ও ফলমুল নিয়ে এসেছে । বারান্দায় প্লস্টিকের চেয়ার গুলোতে বসেছে ।
মহসিনা একটু দূরেই ছিল । তাকে গফফার বলল - যা সাথির মাকে সালাম দে ।
সে সালাম দিয়ে বাচ্চাকে সতিনের কোলে দিল । সে বুঝাতে চায় সে কত ভাল , জীবন দিয়ে হলেও সে সতিনের সেবা যত্ন করবে ।এই ছেলেকে সৎ মাকে নিজের ভাবতে শেখাবে ।

মরিওম দেখাতে চায় সেও কতখানি মহৎ । দুনিয়ার বুকে এই প্রথম সে ইতিহাস তৈরি করতে চায় । সে সতিনের ছেলেকে কোলে নিল এবং নিজেদের আনা একটি নতুন জামা পরিয়ে দিল ।আর সে জন্যই সে এসেছে ।

সদ্যফোটা ফুলের মত শিশুটি সৎ মায়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে । জানেনা সে কে আপন কে পর। শুনতে চায় না সে তার জন্ম বৃত্তান্ত । সে চায় মায়া মমতা আর বাঁচার অধিকার ।

সাথি ও সিমথিয়া মাকে যখন ফ্রি দেখল তারাও ফ্রি হলো । ওরাও বাবুকে কোলে নিয়ে অনেক মজা করল ।

গফফারের মুখে সে কি হাসির ঝিলিক ! সে ভাবে দুনিয়াতে তার কোন আর বাধা নাই । আজ সে খুব ফ্রি । মনের মধ্যে যে সব কথা লুকোচুরি খেলছিল তা আজ ফাস হয়ে গেছে । আর কি চাই ।

লোকে বলল , এখনও দুনিয়ার বুকে মানুষ আছে বটে । এমন সতিন কে দেখেছে । যাক বাবা মহসিনার কপালটা ভাল । গরিবের মেয়ে করে খাক ।

যে মহিলাটি সেদিন সিমথিয়াকে সৎ মায়ের ধারণা দিয়েছিল সেও এসেছে ।
মহিলাটি মহসিনার মাকে বলল - ভালই জামাই পেয়েছিস , দুটি ইটের ঘর করে দিল , খাপ খোরাকও দেয় । কুটুম কে ভালবাসিস । অবহেলা করিস না ।

মহসিনার মা বলল – তোর কি মাথা খারাপ, ওরা ছাড়া আমার আর কে আছে ?

মরিওম এসব কথা পুরোপুরি শুনতে না পারলেও আন্দাজ করছিল । সে কিছু বলল না । যথারিতি অনুষ্ঠান শেষ হলে তারা আবার বাসায় ফিরে এল ।

এখন গাফফারের দুটি পরিবারই মোটামুটি শান্ত । মরিওমের সতিনের ভাবনাটি মেয়ে মরার দুক্ষে কিছুটা চাপা ফেলেছে , আগের মত আর সব সময় কাঁদে না । সে ভাবে কেন এমন হল , আরো কি হবে ? কখন সাথির বিয়ে হবে ?কোথায় পাব সাথির বিয়ের টাকা ? সাথির চাকুরি হবে কিনা ? কখন সিম্থিয়ার লেখাপড়া শেষ হবে , ইত্যাদি ।

এখন স্বামি বাসায় এলে এসব নিয়ে আলাপ আলোচনা করে । কখনো কখনো প্রাণখুলে হাসে । সতিন ও সতিনের ছেলের ভালোমন্দও একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল ।

গাফফার একদিন বলল- বাবুটা বড় হলে মহসিনাকে তালাক দেব , তুমি বাচ্চাটাকে মানুষ করিও।
মরিওম বলল – তালাক দিবেন কেন ? গরিবের মেয়ে থাক , ওরা তো আমাদেরই আশা করে ।




সাত
প্রচন্ড শিত পড়েছে । সিফাতবাবুর কয়েকদিন থেকে অসুখ ।বিছানায় একদম টিকতেই চায় না । তাই একাধারে বেশকিছু দিন হলো গাফফার সাথিদের কাছে আসেনি । মিজানেরও আসাযাওয়া নেই । ফলে বাসায় কোন খরচ নেই বললেই চলে । ভাড়াটেদের কাছ থেকে টাকা তুলে সাথি বাজারে এসেছে খরচ করতে ।একমাসের খরচ করেছে সে ।তরকারি হাটিতে কিছু তরিতরকারি রিকসায় তুলছে এমন সময় পরিচিত এক লোকের সাথে দেখা হলো ।
এই লোকটি হলো সেই লোক যে ওদের বাড়িতে দির্ঘ্য পাঁচ বছর ছিল । যার লেখাপড়ার খরচ সাথির মা বাবা জোগাত ।ওর সাথে সাথি কত হেসেছে কত খেলেছে তার অন্ত নেই । ওর নাম রাজু । এই রাজুর কারণেই আপু অকালেই জীবন দিয়েছে ।সাথির ইচ্ছা করছে না যে তার সাথে কথা বলে।
রাজুই প্রথমে বলল –কে রে সাথি ? কেমন আছিস ?
সাথি অনিচ্ছা স্বত্বেও যেন বলে – ভাল ।
রাজু- আম্মা ভাল আছেন ?
সাথি – আছে ।
রাজু – শুনছি আরেকটা না কি নতুন শ্বাশুড়ি হয়েছে ?শালাও নাকি হয়েছে একটা?
সাথি- কোথায় শুনলেন ?
রাজু – আমি সব খবর রাখি রে সব খবর রাখি । দিনে একবার হলেও তোদের বাসার সামনে দিয়ে যাওয়া আসা করি আর ফিরে ফিরে দেখি । আমার কপাল মন্দ রে । নইলে কেন এমন হবে ? তুই যে মিজান নামের এক ছেলেকে ভালবাসিস তাও আমি জানি । এই দেখ আমার মোবাইলে তোদের ছবি । আমি দূর থেকে তুলেছি । প্রতিদিন শোয়ার সময় তোর ছবি গুলো দেখি । তার পর ঘুম যাই ।
সাথি- ও সব কথা এখন বাদ , সম্ভবত সে ভালোবাসায় ভাটা পড়েছে ।
রাজু – কথা মন্দ নয় , আমি একদিন ও ছেলের মোটর সাইকেলে একটি মেয়েকে দেখেছি । এখন তোকে কে বিয়ে করবে বল । এ এলাকার সবাই জানে তুই মিজানকে ভালবাসিস ।
সাথি হতাসার চোখে রাজুর দিকে তাকায় ।
রাজু বলল- তোর ফোন নম্বর টা দেনা , দেখি যদি কিছু একটা করতে পারি ।
সাথি তার ফোন নম্বর দেয় ।
রাজু বলল- তুই রেডি থাকিস , আমি যে ভাবেই হোক তোর এ বিয়ে দেবই।

সাথি বাসায় এসে মাকে ঘটনা টি বলল ।

ওরা মনে মনে ঘর গোছায় বিছানা বালিস পরিস্কার করে । ঘরের কোনায় যে সব মাকড়সার জাল ছিল তা ঝেড়েঝুড়ে পরিস্কার করে । সাথি মেইন গেট টি খুলে পথের পানে চেয়ে থাকে ।

কথা মিথ্যা নয় - এক সময় গিড় গিড় করে আট দশটি মোটর সাইকেল বাসায় ঢুকল । মাঝের গাড়ির পিছনে আছে মিজান ।দেখেই বুঝা যাচ্ছে যে ওকে ধরে আনা হয়েছে । ওরা বসার ঘরে বসল । মিজানের হাত থেকে মোবাইল ফোনটি কেড়ে নেওয়া হয়েছে যাতে সে কোথাও ফোন না করতে পারে ।

রাজুর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ি ফোন করা মাত্রই কাজি ও ভ্যান বোঝাই যাবতীয় বিয়ের খরচসহ বাবুর্চি এল ।

দশ লক্ষ টাকা দেন মোহর ধার্য্য করে শুভবিবাহের কার্য্য সম্পন্ন করা হলো ।বাসর ঘর সাজানো হলো । মিজান সাথির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে । বলেছে আর কোনদিন এমন বেয়াদবি করবে না । মিজান এখন ফ্রি ।

পরের দিন ছিল ছুটির দিন । ফলে তারা সারা দিন আনন্দ ফুর্তিতে কাটল । বিকেলবেলায় রাজু একটা মাইক্রো ডাকল । মাইক্রতে ওঠার সময় রাজু সাথির এক হাত মিজানের হাতে দিয়ে বলল – বহতা নদির মত হোক তোমাদের জিবণ , আমার মত যেন না হয় । টপ টপ করে রাজুর চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি ঝরে পড়ল । মাক্রোর জানালা দিয়ে রাজু বলল – কাল আমি তোমাদের বাসায় আসব । মাইক্রো ছেড়ে দিল ।ওরা দাঁড়িয়ে রইল ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Supti Biswas খুব চমৎকার লেখা। ভোট রইল এবং আমন্ত্রণ রইল আমার পাতায়। শুভকামনা
ভালো লাগেনি ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২০
Neerob ভালো লিখেছেন। ধন্যবাদ আর ভোট।
ভালো লাগেনি ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২০
গোলাপ মিয়া অসাধারণ লাগল প্রিয়। ভোট রইল। আমার গল্প কবিতায় আপনাকে আমন্ত্রণ।
ভালো লাগেনি ২ ফেব্রুয়ারী, ২০২০
ফয়জুল মহী অনন্যসাধারণ লিখনী । শুভেচ্ছা সতত ।
ভালো লাগেনি ১ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

জীবণ যেন এক বহতা নদী - এটি একটি প্রেম কাহিনী । এ গল্পটি কোন মানুষের জীবন কাহিনী নিয়ে রচিত নয় । এটি সম্পূর্ন কাল্পনিক । প্রেম চিরোদিনই ছিল এবং থাকবে কিন্তু প্রেম কিছু কিছু মানুষের জীবন থেমে দেয় । পরিবারে নেমে আনে অশান্তি । এরই একটি দৃষ্টান্ত এই গল্পটি ।

১২ ডিসেম্বর - ২০১৯ গল্প/কবিতা: ১০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪